Wednesday, June 13, 2018

মনীষীদের ছেলেবেলা সম্পর্কে কিছু মজাদার তথ্য



॥ অবাক-করা ছেলে ॥

দক্ষিণ পশ্চিম ভারতের সমুদ্রতীরে একটি দেশ । নাম তার কেরল । প্রায় বারোশো বছর আগে সেই রাজ্যে এক শিশুর জন্ম হয়েছিল। নাম তার শংকর । 
শিশুটি যত বড় হয় তত তার নানা রকম গুণ প্রকাশ পেতে থাকে। একবার যা শোনে চিরদিনের জন্য তার মনে তা গেথে যায়। মাত্র তিন বছর বয়সে সে-দেশে প্রচলিত সব ভাষায় যে-কোন বই সে পড়তে পারত।
তখনকার দিনে সবাই টোলে পড়াশোনা করত। শংকরও টোলে ভরতি হল। টোলের এক কোণে বসে সে পড়াশোনা করত। গুরুমশায় অন্যদিকে উপরের শ্রেণীর ছাত্রদের পড়াতেন। সেখানে শাস্ত্রের নানা কঠিন বিষয়ের আলোচনা হত।
শংকরের বয়স তখন মাত্র পাচ বছর । একদিন তার মুখে এক অদ্ভুত কথা শুনে গুরুমশায় চমকে উঠলেন । উপরের শ্রেণীর ছাত্ররা অনেক মাথা ঘামিয়েও যা পারে না তা অতি সহজেই সে বলে দিল। বালক এক কোণে বসে কখন যে উচ্চতর শস্ত্র আয়ত্ত করে ফেলেছে, সে খবর কেউ রাখে না। গুরুমশাই বুঝলেন, বিরাট প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। সেদিনই তিনি শংকরকে ওপরের শ্রেণীতে বসবার অনুমতি দিলেন।
বেদ-বেদান্ত, স্মৃতি, পুরান প্রভৃতি শাস্ত্রে জ্ঞান লাভ করে শংকর টোল ছেড়ে ঘরে ফিরে এলো। তখন তার বয়স সাত বছরও পূর্ণ হয়নি।
এই ছেলে পরবর্তীকালে মহাবিজ্ঞানী শংকরাচার্য।

॥রাজার ছেলে পন্ডিত॥ 

এক বছর আগেকার কথা পূর্ববাংলার বিক্রমপুরের রাজা ছিলেন কল্যানশ্রী। সেই রাজার এক ছেলে ছিল-নাম চন্দ্রগর্ভ, আরেক নাম অতিশ। 
তখনকার দিনে এখনকার মতো বইপত্র ছিল না, আর বিদ্যালয়ও ছিল না। পড়তে হতো পুঁথি, আর যেতে হতো টোলে পণ্ডিতদের কাছে।
অতিশ রাজার ছেলে, তাই তাকে টোলে যেতে হয়নি। পণ্ডিতরাই এসে তাকে বাড়িতে পড়াতেন। কিছুদিন পড়াবার পরই পণ্ডিতরা বুঝতে পারলেন অতীশকে শেখাবার মত বিদ্যা তাদের আর নেই।
রাজা কল্যানশ্রী নানা দেশ থেকে বড় বড় পন্ডিত এনে ছেলেকে নানারকম জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা শেখাতে লাগলেন। অনেক কিছু শিখেও অতীশের আশা মিটলো না। বাংলা দেশ ছেড়ে চললেন বোম্বাইয়ের কাছাকাছি কৃষ্ণগিরি বিহারে। সেখানে রাহুলগর্ভ নামে এক মহাজ্ঞানী পন্ডিত ছিলেন। তার সকল বিদ্যায় তিনি অতীশকে শেখালেন।
দেশে ফিরে অতীশের ঘরে থাকতে মন করল না।তিনি মগধের ওদন্তপুরী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চললেন। সেখানে ছিলেন প্রবীণ পন্ডিত সিল রক্ষিত। পেয়ে তিনি খুব খুশি হলেন। তাঁর প্রতিভা আর জ্ঞান দেখে তিনি এর নাম দিলেন অতিশ দীপংকর। অগাধ জ্ঞানশালী বলে তার আরেক নাম ছিল শ্রীজ্ঞান। অতীশ দীপংকর দুর্গম পথ অতিক্রম করে সুদূর তিব্বতে গিয়ে জ্ঞানের আলো জ্বেলেছিলেন।

॥যিনি রাজার মত সম্মান পেয়েছিলেন॥

জমিদার রামকান্ত রায়ের ছেলে রামমোহন। ফুটফুটে চেহারা, নাদুস নুদুস শরীর। খুব দুরন্ত, তবু লেখাপড়ায় তার ভারী মনোযোগ।
অক্ষর-পরিচয় হতে রামমোহনের দু'তিন দিনের বেশি লাগলনা। ফলা-বানান এবং যুক্ত-অক্ষরও তিনি দু'তিন দিনের মধ্যে শিখে ফেললেন।
সেকালের হিন্দুদের মধ্যে আরবি ও ফারসি শেখার রেওয়াজ ছিল। ওই ভাষা না শিখলে সরকারি কাজকর্মে খুব অসুবিধে হতো। রামকান্ত তাই ছেলেকে আরবি ও ফারসি শেখাবার ব্যবস্থা করলেন।
রামমোহন অল্পদিনের মধ্যে ওই দুটি ভাষা শিখে মৌলভীদের পর্যন্ত তাক লাগিয়ে দিলেন।
তারপর তাকে সংস্কৃতি শেখানো হতে লাগলো। সংস্কৃত ভাষা অতি কঠিন অথচ কয়েক মাসের মধ্যেই রামমোহন সংস্কৃত ভাষায় পণ্ডিত হয়ে উঠলেন। রামমোহনের বয়স তখন খুবই কম। মা তারিনী দেবী ছেলেকে নিয়ে তার বাবার বাড়িতে গেলেন। তারিনী দেবীর বাবা শ্যাম ভট্টাচার্য শিব পূজা করতেন। তিনি একদিন পূজা শেষ করে একটি বেলপাতা রামমোহনের হাতে দিলেন। বালক রামমোহন বেলপাতাটি মাথায় না ছুঁইয়ে চিবিয়ে খেতে লাগল। শ্যাম ভট্টাচার্য নাতিকে অভিশাপ দিলেন- "তুই বিধর্মী হবি।" 
তারিনী দেবী সে কথা শুনে কান্নাকাটি করতে লাগলেন। তখন শ্যামচরণ মেয়েকে সান্তনা দেবার জন্য বললেন-"তোর ছেলে মহাপন্ডিত হবে, রাজার মত সম্মান পাবে।"
বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের অভিশাপ ও আশীর্বাদ দুই সফল হয়েছিল। রামমোহন ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচার করেছিলেন এবং দেশের অনেক কুসংস্কার দূর করেছিলেন। দেশ-বিদেশে তিনি পেয়েছিলেন রাজার মত সম্মান।

॥পন্ডিত মশাই অবাক॥ 

ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স তখন চার বছর পাঁচ মাস। পিতা ঠাকুরদাস তাকে পাঠশালায় ভর্তি করিয়ে দিলেন। পাঠশালায় পন্ডিত কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় স্বরবর্ণের পাতা খুলে ঈশ্বরচন্দ্রকে বললেন-"পড়ো অ.আ.ই.ঈ।" দু-তিনবার পড়ানোর পর ঈশ্বরচন্দ্র সবগুলো অক্ষর শিখে ফেলল।
পণ্ডিতমশাই ভাবলেন, স্বরবর্ণ পর্যন্ত সেদিন নতুন ছাত্রটিকে পড়াবেন। কিন্তু ঈশ্বর আরো শিখতে চায়। তখন পণ্ডিতমশাই ব্যঞ্জনবর্ণও তাকে সেখালেন। দু-তিনবার পড়েই সমস্ত ব্যঞ্জনবর্ণ ঈশ্বরচন্দ্রের মুখস্থ হয়ে গেল। শুধু মুখস্ত নয়-লিখতেও সে শিখে ফেলল। পণ্ডিত মশাই অবাক! ঈশ্বরচন্দ্র তিন বছরের মধ্যেই পাঠশালার পড়া শেষ করে ফেলল। পন্ডিত কালীকান্ত একদিন ঠাকুরদাসের এর কাছে বললেন-"আমার পাঠশালায় ঈশ্বর তিন বছরে যা শিখেছে, পাঁ-ছ'বছরেও অন্য ছেলেরা তা পারে না। এবার ওকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে পড়ান।" 
ঐ ছোট বয়সেই ঈশ্বরচন্দ্র বাবার সঙ্গে পায়ে হেঁটে কলকাতা চলল। পথে যেতে যেতে দেখতে পেল মাইলস্টোনের ওপর ইংরেজি অক্ষর। তা দেখে পথের দূরত্ব জানা যায়। একবার করে দেখেই ইংরেজি সব অক্ষর সে শিখে ফেলল।
সংস্কৃত কলেজে ঈশ্বরচন্দ্র মাত্র আট বছর বয়সে ভর্তি হল। এত কম বয়সে কোন ছেলে সংস্কৃত কলেজে এর আগে ভর্তি হয়নি। তার প্রতিভা দেখে অধ্যাপকরাও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
সবাই ভেবেছিলেন এই ছেলে বড় হয়ে মস্ত বড় পন্ডিত হবে। সে ভাবনা সত্যি হয়েছিল অতি অল্প বয়সেই ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় 'বিদ্যাসাগর' উপাধি লাভ করেছিলেন। আজও সকলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নামে মাথা নোয়ায়।

॥বাংলার বাঘ॥ 

আশুতোষ তখন শিশু। বিদ্যালয়ের ছাত্র। এই বয়সে অনেক ছেলে পড়ায় ফাঁকি দিয়ে খেলাধুলা করতে ভালবাসে। আশুতোষের সে সব নেই। পড়াশোনায় তার বেশি মনোযোগ। 
একবার তার কঠিন অসুখ হল। চিকিৎসার পর অসুখ সেরে গেল বটে, কিন্তু শরীরের দুর্বলতা কাটল না। চিকিৎসকরা বিধান দিলেন যে, কিছুদিন পড়াশোনা করা চলবে না, পুরো বিশ্রাম নিতে হবে। কিন্তু আশুতোষ পড়াশোনা ছাড়া একটি দিনও থাকতে পারে না। লুকিয়ে লুকিয়ে স্কুলের বই পড়ে। পিতা গঙ্গাপ্রসাদ তা জানতে পেরে ঘর থেকে বই-খাতা-কলম সব সরিয়ে ফেললেন। এমনকি এক টুকরো খড়িও ঘরে রাখতে দিলেন না। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। যাতে কোনো উপায়ে ছেলে পড়াশোনা না করতে পারে। 
একদিন গঙ্গাপ্রসাদ বন্ধ ঘরে ছেলে কি করছে তা দেখবার জন্য জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি দেখলেন হাতের কাছে কোনো কিছু না পেয়ে আশুতোষ এক টুকরো কয়লা নিয়ে ঘরের মেঝের উপর লাইন কাটছে। বুঝতে পারলেন, জ্যামিতির কঠিন প্রশ্নের করেছে। গঙ্গাপ্রসাদ অবাক হয়ে গেলেন।
এই বয়সেই আশুতোষের পড়াশোনায় কি আগ্রহ আর কি তার প্রতিভা। সমবয়সী ছেলেদের মধ্যে এমন খুব দেখা যায় না। আর কি অসীম তার সাহস! কোন কিছুতেই সে ভয় করে না। 
এই ছেলে 'বাংলার বাঘ'-আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।

ধন্যবাদ........


No comments:

Post a Comment