যুদ্ধে ঘুড়ির ব্যবহার
খ্রীস্টপূর্ব ছিয়ানব্বই অব্দের কথা । চীনা সেনাপতি হান সিনাত্র শত্ৰু শিবিরের দূরত্ব মাপার জন্য অভূত এক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল শত্রু শিবিরের দূরত্ব জানতে পারলে সুড়ঙ্গ কেটে চারদিক থেকে তাদের শিবিরকে ঘিরে ফেলবেন। বহু চেষ্টা করেও উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে পারলেন না। বিষগ্ন মনে উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টায় ব্রতী হলেন দোর্দণ্ড প্ৰতাপ সেনাপতি। হঠাৎ তার মাথায় চমৎকার একটি মতলব এল। ব্যস, আর দেরী নয়, দিলেন আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে। সূতো ছেড়ে ঘুড়িটিকে নিয়ে গেলেন শত্রু - শিবিরের মাথার ওপর । গোঁত্তা মেরে সেটিকে নামিয়ে আনলেন একেবারে শিবিরের কাছাকাছি। এদিকে আকাশে রঙিন ঘুড়ির খেলা দেখে শত্রুপক্ষের সৈন্যরা মজা লোটা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারল না। সেনাপতি হানসিন এবার ঘুড়িটিকে নামিয়ে আনলেন । সুতোর দৈর্ঘ্য মেপে শত্ৰ - শিবিরের দূরত্ব সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা করে যেতে তাথ অসুবিধে হল না। এবার সৈন্যরা কোদাল - শাবল নিয়ে মেতে গেল সুড়ঙ্গ তৈরীর কাজে। এক সময় সুড়ঙ্গ পথে হানসিন - এর সৈন্যরা রাত্রির অন্ধকারে হুড়মুড় করে শত্রু - শিবিরে ঢুকে পড়ল। শত্রুপক্ষের সৈন্যরা তখন নিশ্চিন্তে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। ঘুম ভাঙার আগেই হাসিন-এর সৈন্যরা তাদের কচুকাটা করল । যুদ্ধে জয়লাভ করে বিজয় - পতাকা উড়িয়ে দিল । ঘুড়ির কেরামতিই তাদের যুদ্ধের সাফল্যকে ত্বরান্বিত করল , অস্বীকার করার উপায় আছে কি ?
গৃহযুদ্ধে ঘুড়ি
ঘুড়িকে যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে এরকম নজীর ভুরি ভুরি রয়েছে। এবার আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা বলছি । আঠার শ ’ চৌষট্টি - পয়ষট্টি খ্রীস্টাব্দে আমেরিকার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সূচিত হয়েছিল । সে বছর গৃহযুদ্ধের আগুনে আমেরিকা দাউ দাউ করে জ্বলছিল। অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিল । তখন গৃহযুদ্ধের গতি প্রকৃতি এবং ভবিষ্যৎ কর্তব্যের কথা জনগণের মধ্যে প্রচারের জন্য অভিনব পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন। ঘুড়ির সাহায্যে ছাপানো হাজার হাজার প্রচারপত্র দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল ।
যুদ্ধে প্রথম ঘুড়ির ব্যবহার
এবার আরও বছর পঞ্চাশেক এগিয়ে এলে দেখতে পাব প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অর্থাৎ উনিশ শ’ তেরো-চৌদ্দ খ্রীস্টাব্দে ঘুড়িকে যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল।
তখন বিশালায়তন ঘুড়িতে চেপে শত্ৰ-শিবিরের খোঁজখবর নেয়া হয়েছিল এরকম বহু নজীর হয়েছে। তবে তখন গ্যাস বেলুনে চেপে ওপরে ওঠা এবং বাতাসে ভর দিয়ে পথ পাড়ি দেবার কৌশল মানুষ রপ্ত করে ফেলেছে। শত্রুপক্ষের খবরাখবর সংগ্রহ করতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ঘুড়ি ছাড়াও বহু গ্যাস বেলুনকে যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।
চোরাকারবারে ঘুড়ির কীর্তি
এবার আর যুদ্ধের কাজে নয়, চোরাকারবারীরা কিভাবে ঘুড়িকে ব্যবহার করে লক্ষ লক্ষ পাউন্ড কামিয়ে নিত সে সম্বন্ধে দু’চার কথা আলোচনা করা যাক। উনিশ শতকে ফরাসী দেশে চোরাচালানকারীদের খুব উৎপাত শুরু হয়। তাদের এ কাজের সবচেয়ে বড় সহায়ক ছিল ঘুড়ি। সোনাদানা থেকে শুরু করে গাঁজা, আফিং প্রভৃতি হাল্কা
এবং বহুমূল্য সামগ্রী ঘুড়ির সঙ্গে বেঁধে দূরবর্তী অঞ্চলে চালান দিত।
ঘুড়ির টানে নৌকা চলে
উনিশ শ’ তিন খ্রীস্টাব্দে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের এক যুবকের মাথায় চমৎকার এক ফন্দি এল। তার সাধ হল ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করবে। তাই বলে কোমরে
ঘুড়ির সূতো বেধে অবশ্যই নয়। তবে ? অতিকায় একটি ঘুড়ির সুতো দিল নৌকোর সঙ্গে বেধে। ব্যস, ঘুড়ির টানে দিব্যি নৌকাটি দীর্ঘ জলপথ পাড়ি দিয়ে ফেলল।
ব্যর্থ মনোরথ
ইশিকাওয়া নামে এক চোর ছিল। খুবই সুচতুর ছিল সে। ফলে নিত্য নতুন চুরির কৌশল বের করে দু’হাতে টাকা ঘরে তুলতে লাগল ইশিকাওয়া। মহাধুরন্ধর ছেলেটি
একবার মতলব আঁটলো রাজার দুর্গের চূড়ায় যে সোনা ও মণিমুক্তা খচিত ডলফিন মূর্তিটি রয়েছে সেটি চুরি করবে। কিন্তু হাজারো সমস্যা তাতে। মূর্তিটি অনেক উচুতে অবস্থিত। আর দুর্গের চারদিকে উচু প্রাচীর।টপকানো বড়ই কঠিন। তার ওপর বড় সমস্যা হচ্ছে, সশস্ত্র প্রহরী সর্বদা টহল দিচ্ছে। এখন উপায়? অত্যুগ্র ইচ্ছাশক্তিই তার মাথায় মতলব এনে দিল। বিশালায়তন একটি ঘুড়ি বানিয়ে ফেল ইশিকাওয়া। এবার সদ্য তৈরী ঘুড়িটি নিয়ে গেল দুর্গের প্রাচীরের বাইরে। সঙ্গে করে নিয়ে গেল। তার কয়েকজন সঙ্গীসাথীকে। এবার ঘুড়ির সঙ্গে নিজেকে বাঁধল। অর্থাৎ একটি খাঁচার মধ্যে নিজে গুটিগুটি হয়ে বসল। ঘুড়ির সঙ্গে সঙ্গীরা খাঁচাটিকে বেঁধে দিল। ব্যস, এবার খাঁচাসমেত ঘুড়িটি উড়ল আকাশে। দমকা বাতাসের টানে ঘুড়িটি উঠতে লাগল। ছেলেরা ঘুড়িটিকে নিয়ে গেল দুর্গের চূড়ার কাছে। এবার সে হাত বাড়িয়ে সোনার ডলফিনের পাখনাটি ধরার চেষ্টা করল। বরাত মন্দ। এক গোত্তা মেরে ঘুড়িটি সামান্য সরে গেল, চলে গেল বেশ কিছুটা দূরে। কেবলমাত্র ডলফিনের ঝকঝকে চকচকে সোনার পাখনাটি রয়ে গেল তার হাতের মুঠোয়। বরাত মন্দ। তার সঙ্গী সাথীরা বহু চেষ্টা চরিত্র করেও ঘুড়িটিকে আর মূর্তিটির কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারল না। বার বার চেষ্টা করেও যখন অভীষ্ট সিদ্ধ করতে পারল না। তখন ছেলের দল অনন্যোপায় হয়েই ইশিকাওয়াকেসহ ঘুড়িটি নামিয়ে আনল। পাখীর ডাকে সকাল হল। পূর্ব আকাশে দেখা দিল রক্তিম সূর্যের আভা। দেখতে দেখতে সোনালী রোদ দেখা দিল গাছের মাথায় মাথায় আর দুর্গের চূড়ায়। হঠাৎ প্রহরীদের নজর পড়ল ডলফিনের মূর্তিটির দিকে। হায় হায় করে উঠল তারা। ডলফিনের একটি পাখনা গেল কোথায়। এ যে কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে! রাজা গর্দান না-নিয়ে ছাড়বেন না। এখন উপায়! বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল চুরির খবরটি। দলে দলে সশস্ত্র সৈন্য পাড়ায় পাড়ায় টহল দিতে লাগল। ইশিকাওয়াকে ধরতে দেরী হল না। বামালসমেত ধরে ফেলল। ঘুড়িতে ওড়া বিশ্বের প্রথম মানুষটিকে জলে ডুবিয়ে শাসরুদ্ধ করে মারা হল। তার আবিষ্কার মর্যাদা পেল না। চুরির করার শাস্তি যে পেতেই হবে চোরকে। বুদ্ধির দাম দিতে গিয়ে চোরকে তো আর প্রশ্রয় দিয়ে আইন ভাঙা যায় না।
No comments:
Post a Comment