Saturday, June 16, 2018

ম্যারাথন ও থার্মপলির যুদ্ধ


《 ম্যারাথন ও থার্মপলির যুদ্ধ 》

প্রাচীন গ্রীস যে এক সময় সভ্যতার খুব উচু- তলায় উঠেছিল এ কথা তোমরা নিশ্চয়ই জান। গ্রীসে যখন নগর-রাষ্ট্র গড়ে উঠছে ঠিক সেই সময় পারসিক সম্রাট এশিয়া মাইনরের গ্রীক রাষ্ট্রগুলি এক এক করে দখল করে নিচ্ছেন। এই পারসিক সম্রাটদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন রাজা দারায়ুস।
দারায়ুসের আমলে এশিয়া মাইনরের গ্রীক উপনিবেশবাসীরা এক বিদ্রোহ করে বসল। ইতিহাসে এই বিদ্ৰোহ আইওনিয়ান বিদ্রোহ বলে খ্যাত। এথেন্স এবং আরো কিছু গ্রীক নগরী এই বিদ্রোহকে সমর্থন করল, বিদ্রোহে তারা যোগও দিল। এথেন্সবাসীরা পারসিক সাম্রাজ্যের এশিয়া মাইনরের রাজধানী সারদিস নগরে আগুন জ্বালিয়ে দিল। পারসিকদের রাজধানী পুড়ে শেষ হয়ে গেল ।
বলা বাহুল্য, এই ঘটনা রাজ দারায়ুসের মনেও আগুন ধরিয়ে দিল। সেই সঙ্গে বিদ্রোহের আগুন মিলে হল একাকার। দারায়ুস প্রতিজ্ঞা করলেন এথেন্সকে শাস্তি দিতে হবে। জয় করতে হবে এথেন্স। সেই উদ্দেশ্য নিয়ে প্রস্তুত হল ছ’শো জাহাজ। এই জাহাজে করে চল্লিশ হাজার সৈন্য চলল এথেন্স অভিমুখে।
পাহাড়ে ঘেরা গ্রীস দেশ ; তার তিন দিকে সমুদ্র। এথেন্সের বাইশ মাইল উত্তর-পূর্বে ম্যারাথন বলে। একটি জায়গা আছে। দারাসের সৈন্যরা সেখানে যুদ্ধের তাবু বসাল। এদিকে এথেন্সের সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র ন’ হাজার। কিন্তু মিলটিয়াডিস নামে একজন সেনাপতি এই ন’হাজার সৈন্য নিয়েই যুদ্ধের নেতৃত্ব করলেন। পথে আরও এক হাজার সৈন্য সংগ্রহ হল। মোট দশ হাজার সৈন্য ম্যারাথনের যুদ্ধক্ষেত্রে পারসিকদের আক্রমণ করল। গ্রীকরা যুদ্ধ করতে লাগল তাদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য। আশ্চর্য বীরের জাতি তারা। জীবন-মরণ সমস্ত কিছু তথন তাদের কাছে তুচ্ছ। তাদের প্রচণ্ড আক্ৰমণে পারসিকরা সহ্য করতে পারল না। কোনও রকমে তারা জাহাজে উঠতে পারলে বাঁচে। গ্রীকরাও তাড়া করে করে বহু পারসিককে মেরে ফেলল। অবশিষ্ট যারা ছিল তারা কোনও রকমে দেশে ফিরে এল।
ম্যারাথন যুদ্ধে হেরে গিয়ে সম্রাট দারাযুস আরও  ক্রুদ্ধ হলেন। পরাজয়ের প্রতিশোধ তাকে নিতেই হবে। কিন্তু এবার আর সৈন্যদের পাঠিয়ে নয় ; তিনি নিজেই যুদ্ধে যাবেন স্থির করলেন । শেষ পর্যন্ত বাসনা পূর্ণ হল না দারায়ুসের।
তার মৃত্যু হল অল্পদিন পরে। এবার পারস্যের সম্রাট হলেন তার ছেলে জেরাক্সেস। জেরাক্সেস পিতার উপযুক্ত পুত্র। পিতৃসত্য রক্ষা করতে তিনি নিজেই চললেন এথেন্সে। বিরাট স্যৈবাহিনী নিয়ে পারস্যরাজ এসে পৌছলেন থ্রেস ও ম্যাসিডোনিয়ার ভিতর দিয়ে থার্মপালি গিরিবত্মে -র কাছে। 
থার্মপালি এক আশ্চর্য যুদ্ধক্ষেত্ৰ। পাহাড়ের মধ্যে সরু পথ । সেই পথে সাত হাজার গ্রীক সৈন্য জেরাক্সেসের অগণ্য সেনার জন্য অপেক্ষা করছিল। সেই খবর পৌছল জেরাক্সোসের কাছে।
পারস্য-সম্রাট অল্প কয়েকজন সৈন্যকে গ্রীকদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পাঠালেন। তারা হেরে গিয়ে ভয়ে পালিয়ে এল। আবার একদলকে পাঠালেন জেরাক্সেস। তারাও একই ভাবে ফিরে এল। এবার পারস্যরাজ তার নিজস্ব বাছাই-কর দলটি পাঠালেন। এবারেও একই দশা। তারাও মার খেয়ে পালিয়ে এল।
জেরাক্সেস ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। থার্মপলির ঐটুকু গিরিপথে বেশী সৈন্য নিয়েও ঢোঁকা যায় না, আবার অল্প সৈন্যকে গ্রীকরা অনায়াসেই হারিয়ে দেয়। জেরাক্সেস ন'শো জাহাজ নিয়ে এসেছিলেন, আর গ্রীকদের ছিল মাত্র তিনশো জাহাজ। ঐ জাহাজে করে অন্য পথে জেরাক্সেস সৈন্য পাঠাতে চেষ্টা করলেন। এবারও গ্রীকরা প্রাণপণে বাধা দিল। শুধু তাই নয়, একদিন রাত্রে দারুণ ঝড়ে পারস্যরাজের অনেক জাহাজ ডুবে গেল।
দুর্দিনে অন্য পথে আলো আসে। সেই আলো হয়ে জেরাক্সেসের কাছে এল একজন বিশ্বাসঘাতক গ্রীক। সে জানাল যে, থার্মপলি ছাড়া অন্য পথ দিয়ে সে জেরাক্সেসের সৈন্যদের নিয়ে যেতে পারবে। পারস্য-সম্রাট খুশী হয়ে শুধু রাজীই হলেন না, সঙ্গে সঙ্গে একদল সৈন্যকে পাঠিয়ে দিলেন। তারা অনেক ঝোপ-জঙ্গল পেরিয়ে ঘুরপথে, পিছন দিক থেকে থার্মপলিতে গ্রীকদের আক্রমণ করল।
গ্রীকরা বুঝল আর উপায় নেই। তাদের নেতা স্পার্টার বীর রাজা লিওনিডাস গ্রীকদের রক্ষা করার জন্য অধিকাংশ সৈন্যকে পেছনে পাঠিয়ে দিলেন। মাত্র তিনশো স্পার্টান সৈন্য নিয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেই মরণপণ যুদ্ধে। সামনে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু, তবু তারা যুদ্ধ করছে নির্ভীকভাবে। পারসিকদের অনেক সৈন্য তাদের হাতে মারা পড়ল। তবু শেষ পর্যন্ত এরা সবাই মৃত্যু বরণ করল।
থার্মপলির যুদ্ধে গ্রীকদের হার হয়েছে খবর পেয়েই চলে গ্রীক জাহাজগুলো গেল এথেন্সে। সেখান থেকে সমস্ত নারী, শিশু আর বৃদ্ধদের তারা সরিয়ে দিতে লাগল আশপাশের দ্বীপগুলোতে। জেরারোস যখন এথেন্সে এসে পৌছলেন, তখন  সারা শহর অন্ধকার। শুধু পাহাড়ের উপর একটি মন্দির ছিল। কয়েকজন গ্রীক সমবেতভাবে এবারই বাধা দিল জেরাক্সেসকে। পারসিকদের হাতে সবাই নিহত হল। জেরাক্সেস এথেন্স শহরকে ধ্বংস করার হুকুম দিলেন। বেশির ভাগ গ্রীক তথন সালামিস দ্বীপে চলে গিয়েছিল। পারস্যরাজ এই দ্বীপের গ্রীকদের আক্রমণ করার জন্য তার সব জাহাজ পাঠিয়ে দিলেন। এবারে জাহাজে-জাহাজে অর্থাৎ গ্রীক জাহাজের সঙ্গে পারসিক জাহাজের যুদ্ধ চলল। এই যুদ্ধে কিন্তু গ্রীকরা জয়ী হয়েছিল। আর এথেন্সের কাছে এক পাহাড়ের উপর মার্বেল পাথরের সিংহাসনে বসে পারস্য-সম্রাট জেরাক্সেস সেই যুদ্ধ দেখেছিলেন।

No comments:

Post a Comment